উইলিয়াম শেকসপিয়ার এর একটি বানী দিয়ে শুরু করা যায়: যদি আমার ওয়ালেট অপহরন কর, আবর্জনাগুলো নিলে, যা আমার ছিল, কিন্তু এখন তোমার, আবার তা অর্জনও সম্ভব। আবার যদি আমার সুনাম চুরি কর, এমন কিছু নিয়ে নিলে যা আমি প্রতিস্থাপন করতে পারবো না, তা ছাড়া আমি অপরিমেয়ভাবে দরিদ্র।
ব্র্যান্ড হলো সেই সুনাম যা অপহরন হলে আর প্রতিস্থাপন সম্ভব নয় এবং গুরুত্বপূর্নভাবে, এটি হলো ডিএনএ যা ইকুইটি সম্প্রসার করে। প্রতিটি কোম্পানি, ইন্ডাস্ট্রি এমনকি একটি দেশেরও চুড়ান্ত উদ্দেশ্য এটি। দেশের ব্র্যান্ড এই সুনাম কে নির্দেশ করে। বাস্তবে- ধারনা, মনস্তাত্বিক প্রতিচ্ছবি, মূল্যায়ন এবং সুনাম যা দেশের নামের সাথে সম্পৃক্ত করে। কতোগুলো দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান উপাদান রয়েছে যেমন: বিনিয়োগ পরিস্থিতি, জনসংখ্যা, সাংস্কৃতিক সন্নিবেশ, রাজনৈতিক অবস্থান,পরিচালনা অবকাঠামো। এই উপাদানগুলো স্বতন্ত্র ইমেইজ সৃষ্টি করে। কোম্পানি বা পন্য ব্র্যান্ড এর মতো দেশের ব্র্যান্ডিংও এক প্রকার প্রতিস্রুতি বহন করে।
যাহোক, শুধু প্রতুস্রুতিই যথেষ্ট নয়; ইন্ডাস্ট্রি ব্র্যান্ডিং এর শক্তি হলো কার্যোপযোগী ডেলিভারি এবং প্রতিস্রুতি রক্ষা করা। প্রত্যেক জাতিরই ব্র্যান্ড ইমেইজ আছে, হতে পারে নেতিবাচক কিংবা ইতিবাচক। ব্র্যান্ডিং কৌশল প্রয়োগ ব্যতিত ইমেইজ ধরে রাখা কিংবা উন্নত করা যায় না। সেজন্য, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য উদঘাটন ইতিবাচক ব্র্যান্ড ইমেইজ প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ন। ইতিহাস বলে, যারা ইতিবাচক ব্র্যান্ডিং এ সফলতা অর্জন করেছে, তারা প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র কোন একটি বৈশিষ্ট্যকে কেন্দ্র করে এগিয়েছে। মালয়েশিয়া নজর দিয়েছে টুরিজম এর উপর; সিংগাপুর ব্র্যান্ডিং করেছে স্বাস্থ্য-চিকিৎসা ও লজিসটিকস এর উপর; সংযুক্ত আরব আমিরাত ফোকাস করেছে বিশ্ব আকাশ পরিবহনে এবং বর্তমানে শিক্ষায়; আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং যুক্তরাজ্য জোর দিয়েছে জ্ঞানের উপর; কোরিয়া ও জাপান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রযুক্তির মার্কেটার হিসেবে।
উপরের বর্ণনা বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ব্র্যান্ডকে আলাদাভাবে দেখায়। এই ব্র্যান্ড এর সুনাম ক্ষুন্ন হলে, বাংলাদেশের অর্থনীতি মুখ থুবরে পরবে। টিকে থাকার জন্য বড় প্রশ্ন হলো; বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে, কিভাবে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা ধরে রাখা যায় এবং উত্তরোত্তর ব্র্যান্ড ইকুইটিকে শক্তিশালি করা যায়? পৃথক ব্যক্তি পৃথক পরামর্শ দেবেন, কিন্তু আমরা আলোচনা করবো, ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠার কৌশল নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আইবিএর মাননিয় প্রফেসর সৈয়দ ফারহাত আনওয়ার এর প্রকাশিত একটি আর্টিকেল অবলম্বনে সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনায় থাকবে সাতটি ব্র্যান্ড বিল্ডিং ফ্রেমওয়ার্ক।
প্রথম: পাকাপোক্ত ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের পজিশনিং করতে হবে
ব্র্যান্ড বিল্ডিং অনুশীলনে সবার আগে বের করতে হবে স্বতন্ত্র বা ইউনিক বৈশিষ্ট্য। সবাই মেনে নিয়েছে যে, বাংলাদেশের জোর হলো কম খরচে উৎপাদন। কারন, শ্রমিক খরচ কম। এটি হলো, ভুল ধারনা এবং ব্র্যান্ডিং করার মতো কোন শক্তিশালি উপাদান নয়। পোশাকের দাম কমে যাওয়া এবং কম দামে ক্রয়ের জন্য প্রতিদিনই দেশ থেকে দেশে স্থানান্তর টেকসই গতিময়তার বড় বাধা। তবে এই স্বীকৃতি আছে যে, উৎপাদনকর্মীদের দ্রুত শিক্ষার্জন উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি ও খরচ বাচাতে ব্যাপক ভুমিকা পালন করছে। এ থেকে ধারনা পাওয়া যায় যে, সমস্ত সাপ্লাই চেইনে বাংলাদেশের সুবিধা বিদ্যমান। তার কারন, উৎপাদন খরচ কম ও শ্রমিকের কাজ আয়ত্বে আনতে সময় কম লাগে। এই সুবিধাটিই বৃহৎ জনসংখ্যাকে সম্পদে রুপান্তরের মধ্য দিয়ে ব্র্যান্ডকে উন্নত করতে পারে। সুতরাং, কর্মীদেরকে উপযু্ক্ত ট্রেনিং দিয়ে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে এবং পজিশনিংও হবে এই ব্যানারেই।
দ্বিতীয়: টিকে থাকার শক্তি অর্জন করতে হবে
ক্রমোন্নতির হারে বাংলাদেশ নেতৃস্থানে অবস্থান করছে যার নমুনা পাওয়া যায় মানব সম্পদ সৃষ্টিতে। বৃহৎ কোম্পানিগুলোকে শুধু আশ্রয়ই দিচ্ছে না, বরং বাংলাদেশ এখন বিশ্ব উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। বিভিন্ন এনজিও, মাইক্রো ক্রেডিট, এবং শান্তিরক্ষী বাহিনী কতৃক বৈশ্বিক ক্রমোন্নতিতে ভূমিকা রাখছে। এমনকি আরও বড় প্রতিফলন হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্পের ৪০ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থানে। এই কর্মসংস্থানের ফলে শুধু নারীদের উপার্জনই বাড়ছে না, বরং পারিবারিক সুন্দর পরিবেশও গড়ে তুলছে।
এই স্বতন্ত্র প্রচেষ্টা ডেভেলপমেন্ট পার্টনারদের জন্য একটি সুযোগ। পার্টনারদেরকে কনভিন্স করতে হবে যেন, সুযোগটি কাজে লাগাতে পারেন বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে। ফলে, ডেভেলপমেন্ট হরিযোন বৃদ্ধি পাবে। আরেকটু পরিষ্কার করা যাক। শিল্পের প্রবৃদ্ধি দেখে যদি বিদেশি পার্টনাররা বিনিয়োগ করেন, তাহলে তাদের কোম্পানি পরিধি বৃদ্ধি পাবে। অপরদিকে বাংলাদেশ পাবে প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকার শক্তি। অনেকে বলেন, বিদেশি সাহায্যের কথা। বিগত যুগে বাংলাদেশ বিদেশি সহযোগিতার উপর নির্ভরশীলতা গুরুত্বপূর্ণভাবে কমিয়ে এনেছে। বরং, এখন দরকার হলো, যারা সহযোগিতা করতে চায় তাদের সাথে ব্যবসায়িক লেনদেন বাড়ানো। ফলস্বরুপ, বাংলাদেশের শক্ত অবকাঠামো গড়ে উঠবে। এদিক থেকে বিবেচনা করে, বিদেশি বায়ার বা সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সাহায্য নয়, তাদের সাথে বিনিয়োগ ও লেনদেন বাড়ানোর জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
তৃতীয়: শিল্পের বিশ্বায়ন
ব্র্যান্ডিং ফোকাস থাকতে হবে যেন দেশের বাইরেও উৎপাদন কেন্দ্র বৃদ্ধি মারফত পোশাক শিল্পের উন্নয়ন করা যায়। রপ্তানি ব্যবসায়ে এটি একপ্রকার প্রচলিত কৌশল। অভ্যন্তরীন সীমারেখার বাইরে পার্টনারশিপ ও জয়েন্ট ভেঞ্চার করে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে হবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ অফশোর ম্যানুফ্যাকচারিং কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এই সুনাম ও সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বায়ন সম্ভব। বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি এবং ডেভেলপমেন্ট পার্টনারদের সাথে যুক্ত হয়ে প্রসারন করতে পারেন।
চতুর্থ: মান যোগ করা (ভ্যালু এ্যাডিং)
নির্বাচিত কিছু ভ্যালু এ্যাডিং সার্ভিসের দ্বারা আরএমজি সেক্টরকে আরও উন্নত করা যায়। যেমন: ফেব্রিক ডিজাইন, মার্চেন্ডাইজিং, এবং প্রমোশন। সেবাগুলো এখনও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে পারেনি বাংলাদেশ। কতিপয় বায়িং হাউজ মার্চেন্ডাইজিং ও প্রমোশন সেবা প্রদান করছে কিন্তু এটি অযৌক্তিক ও ব্যয়বহুল। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে এটি অসুবিধা হয়ে দাড়াবে। পরিসংখ্যান দেখায় যে, ভারতের রিমিটেন্স অর্জনে বাংলাদেশ হলো পঞ্চম বৃহত্তম উৎস এবং পাচ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান করছে। এবং প্রথম শিল্পটি হলো পোশাক। এই সেবাগুলো নিশ্চিত করতে পারলে হয়তো বাংলাদেশের অর্থ আরেক দেশের রেমিটেন্স হতো না।
তবে, বাংলাদেশ এখন ডিজাইনের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে। তদোপরি, ডেভেলপমেন্ট পার্টনার সাথে নিয়ে সরকার ও একাডেমিক ইনস্টিটিউশন ডিজাইন, মার্চেন্ডাইজিং, প্রমোশন ও মার্কেটিং এর উপর প্রফেশনাল ট্রেনিং এর পদক্ষেপ নিতে পারে। আন্তর্জাতিক রিটেইলিং কোম্পানিরও সো-কল্ড লো কস্ট লেবার এ জোর না দিয়ে ভ্যালু এ্যাডিং এর দিকে বিনিয়োগ করা উচিত।
পঞ্চম: ছোট কোম্পানিকে কমপ্লায়ান্ট মান বজায় রাখতে সহযোগিতা করা
ছোট পোশাক কারাখানাগুলোকে ঘিরে কমপ্লায়ান্স সম্পর্কিত বড় সমস্যা রয়েছে। ব্যয় সুবিধার নিমিত্তে তাদের ভুমিকা গুরুত্বপূর্ন কিন্তু নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত শর্ত্যানুসারে কোম্পানি পরিচালনা করতে পারছে না। এমনকি, ছোট কোম্পানিগুলোকে বাচাতে ব্যর্থ হলে নারী কর্মসংস্থান ও শিল্পের উন্নতি ব্যাহত হবে। এসএমই কে সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ন উদ্যোগ লক্ষ করা যায়। অন্য দিকে সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোও এসএমই তে বিনিয়োগ বাড়াতে চাচ্ছেন। তাদেরকে বাচিয়ে রাখতে এখনই কৌশলগত পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের উচিত সবগুলো এসএমই কে একটি ছাতার অবতলে এনে নির্দিষ্ট নীতিমালা আরোপ করে পরিচালনা করা।
ষষ্ঠ: নেতৃত্ব দেওয়া
যে কোন ব্র্যান্ড বিল্ডিং এ সৃজনশীল ও আউট-অব-বক্স পদক্ষেপ নিয়ে কোন না কোন উদ্যোক্তাকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হয়। যদিও ব্র্যান্ড বিল্ড-আপ করা সময়ের ব্যাপার, রাতারাতি সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন উদ্যোক্তার ইতিবাচক মাইন্ডসেট এবং ক্রেতাকে সর্বোত্তম পন্য বা সেবা সরবরাহ। পোশাক শিল্পের অধিকাংশ উদ্যোক্তাগন অনুসরনকারী. প্রথম জেনারেশন উদ্যোগগ্রহনকারি. এবং ক্ষনস্থায়ী-স্বলমেয়াদী লাভের সন্ধানে ছুটে। মেম্বারদের সংঘবদ্ধ হওয়া ও তাদের পুঞ্জিভুত জ্ঞান অন্যের সাথে শেয়ার করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা যাচ্ছে। অনেক সফল উদ্যোক্তা আছেন যারা বিশ্বমানে পৌছে গেছেন। নতুন উদ্যোক্তাদের সাথে অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে হবে এবং পথ প্রদর্শনে নেতৃত্ব দিতে হবে। উদ্যোক্তাদের মাইন্ডসেট করতে হবে, বিশ্বের চাহিদার যোগান দেয়ার এবং পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার। অন্যদিকে, পোশাক প্রস্তুতকারী থেকে উদ্যোক্তায় রুপান্তরিত হতে হবে। অভিজ্ঞতা শেয়ার এর জন্য বিশ্বব্যাপী কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে।
সপ্তম: আভ্যন্তরিন ব্র্যান্ডিং
ব্র্যান্ডিং এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি অন্যতম উপাদান হলো আন্ত:স্বীকৃতি। বাংলাদেশের প্রত্যেক উদ্যোক্তাকেই এই বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে। এ্যাটায়ার ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে অনেক প্রোপাগান্ডা শোনা যায়। ফলাফল- প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির রসদ যোগান দেয়া হয়ে গেলো। তবে, এর মানে এই না যে দুর্বলতাকে এড়িয়ে যাবো। এর প্রাথমিক ধারনা হলো ইতিবাচক সমালোচনা করা যা আসলে কৌশলগত উন্নয়নে সহায়তা করবে।
এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সিভিল সোসাইটি, মিডিয়া, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং নীতিনির্ধারকদের সাথে ভালো সম্পর্কের। তারাও ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পরোক্ষ ভুমিকা পালন করবে।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করা উচিত উৎপাদন ভিটা হিসেবে, আন্তর্জাতিক মানে, ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড উপাদানের একত্রিকরনসহ। নিশ্চিত করতে হবে যেন শিল্প সংশ্লিষ্ট সকল স্টেকহোল্ডারগন একটা ইউনিট হিসেবে কাজ করে। আভ্যন্তরিন ও বহির্গত অনেক চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করে, বাংলাদেশ পোশাক শিল্প অগ্রগতি চলমান রেখেছে। ভবিষ্যত অনেক উজ্জল হবে যদি সবাই একটা ইউনিট হিসেবে কাজ করতে পারে। এমনকি, ২০২১ সালে ৫০ বিলিয়ন ডলার টার্গেট পূরন করতে বেগ পেতে হবে না। মিশেল এ্যানজেলোর বানী দিয়ে শেষ করা যায়, বড় টার্গেট নেয়া এবং তা পূরন করতে ব্যর্থ হওয়া বিপজ্জনক নয়, বরং, ছোট টার্গেট নিয়ে অর্জন করে ফেলাটা বিপজ্জনক।