স্বাধীনতার উত্তরোত্তর বাংলাদেশের অর্থনীতি চাকার গতি বেড়ে চলেছে। একটা সময় ছিলো যখন নিত্য প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটানোর জন্য ছিলো না অর্থের যোগান, ছিলো না শক্ত উৎপাদন ব্যবস্থা। এখন বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে অনেক শিল্প যা দেশের চাহিদা পূরন করে আন্তর্জাতিক মার্কেট এর চাহিদা মিটাতে এগিয়ে যাচ্ছে। রপ্তানি আয় বাংলাদেশের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। এ লেখার মাধ্যমে তুলে ধরা হবে কতগুলো উঠে আসা শিল্পের কথা যার রয়েছে অপার সম্ভাবনা।
বাইসাইকেল
একসময় দেশের চাহিদা পূরণে ভারত এবং চীন থেকে বাইসাইকেল আমদানি হতো। এখন দেশের চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক মার্কেট এ সাইকেল রপ্তানি করছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারের পাশাপাশি বিশ্ববাজারেও চাহিদা বাড়ছে বাংলাদেশের সাইকেলের। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসেই বাইসাইকেল থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ১১ কোটি ৭২ লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার। যেখানে পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ কোটি ডলারের বেশি বা ৯৩৬ কোটি টাকা। এটা ২০০৭ অর্থবছরেও ছিল মাত্র ছয় কোটি ৪২ লাখ ডলার। ইউরোপীয় দেশগুলোয় বাইসাইকেলের চাহিদা বাড়ছে সবচেয়ে বেশি। এ কারণে দেশে বাইসাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বেড়েছে। বাংলাদেশকে বাইসাইকেল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে চিনিয়েছে মেঘনা বাইসাইকেল লিমিটেড। এ প্রতিষ্ঠানটিই দেশে প্রথম রপ্তানিযোগ্য বাইসাইকেল কারখানা স্থাপন করে গাজীপুরে।
এরপর গড়ে ওঠে আরো চার-পাঁচটি কারখানা। এর মধ্যে রয়েছে এইস বাইসাইকেল লিমিটেড, ট্রান্সওয়ার্ল্ড বাইসাইকেল কম্পানি লিমিটেড, সিরাজ বাইসাইকেল লিমিটেড, জার্মানি-বাংলাদেশ বাইসাইকেল এবং আরএফএল সাইকেল। বর্তমানে এসব কারখানায় প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক কাজ করছে। এসব প্রতিষ্ঠানে তৈরি হচ্ছে মাউন্টেন বাইক, সিটি বাইক, ফ্রি স্টাইল, ট্র্যাকিং, ফোল্ডিং, বিচ ক্রুসার এবং কিডস বাইক। বাংলাদেশে তৈরি এসব বাইসাইকেলের মূল্য রয়েছে ৮০ থেকে ৩০০ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় ছয় হাজার ২০০ থেকে ২৩ হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত। বাংলাদেশ থেকে বেশি বাইসাইকেল রপ্তানি হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোয়। এ ছাড়া আমেরিকাতেও রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশি বাইসাইকেল। দেশীয় বাইসাইকেলের সবচেয়ে বড় বাজার রয়েছে পুরান ঢাকার বংশাল এলাকায়। দেশীয় বাজারে প্রতিবছর প্রায় পাঁচ থেকে ছয় লাখ পিস বাইসাইকেলের চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ব বাজারেও বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয় পাঁচ থেকে ছয় লাখ বাইসাইকেল। দেশের চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক মার্কেট এ বিস্তৃতি লাভ করছে।
আন্তর্জাতিক মার্কেট এ আসবাবপত্র
বদলে গেছে দেশের আসবাবশিল্প। বিশ্বের বুকে জায়গা করে নেয়া এ শিল্পে প্রতিবছরই বাড়ছে রফতানির পরিমাণ। গত ছয় বছরের ব্যবধানে রফতানি বেড়েছে প্রায় সাতগুণ। গুণগত মান, যুগোপযোগী নকশায় আসবাব তৈরির ফলে বিদেশীদের কাছে বাংলাদেশের আসবাব প্রিয় হয়ে উঠছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৬১ কোটি ১৬ লাখ ৩২ হাজার টাকার আসবাব রফতানি হয়। আর ২০১৪-১৫ (মে পর্যন্ত) অর্থবছরে ৩শ’ ৪৪ কোটি ৩০ লাখ টাকার আসবাব রফতানি হয়েছে। এ হিসেবে গত ছয় বছরের ব্যবধানে ছয় দশমিক ৩৫ ভাগ আসবাব রফতানি বেড়েছে। বাংলাদেশে আসবাবশিল্পে একটি বিপ্লব হয়েছে, এভাবে রফতানি বাড়তে থাকলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে শুধু দু-একটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমে আসবে। বিশ্বের বাজারে টিকে থাকতে হলে কয়েকটি গুণ থাকা দরকার। সেই সব গুণাবলী আমাদের দেশের আসবাবশিল্পে বিনিয়োগকারীদের মাঝে রয়েছে। যার ফলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে এ খাত।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বাসাবাড়ি সব জায়গাতেই আসবাবের চাহিদা বেড়েছে। এর ফলে লাখো মানুষের কর্মসংস্থানও বাড়ছে। বর্তমানে এ শিল্পে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ জড়িত রয়েছেন। সময়ের চাহিদায় এ শিল্পে যেমন পরিবর্তন এসেছে, ঠিক তেমনি রয়েছে প্রশিক্ষিত জনবল। তাই দেশের বাজার জয় করে বিদেশীদের মনেও জায়গা করে নিয়েছে এ শিল্প। ১৯৯৭ সাল থেকে আসবাবপত্র বিদেশে রফতানি শুরু হয়। বর্তমানে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, দুবাই, জার্মানিসহ প্রায় ১৬টি দেশে আসবাবপত্র রফতানি হচ্ছে।
সময় টেলিভিশনের একটি রিপোর্ট বলছে, অন্য কথা। আসবাবপত্রের ১৪৯ কোটি ডলারের আন্তর্জাতিক মার্কেট এ বড় সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এখনও পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এর কারণ হিসেবে চ্যানেলটি উল্লেখ করে, কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চ শুল্কের পাশাপাশি রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনা না দেয়াকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। আসবাবপত্র শিল্প মালিক সমিতির চেয়ারম্যান সেলিম এইচ রহমান বলেন, ‘কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে উচ্চ শুল্ক কমিয়ে আনলে ও রপ্তানির ক্ষেত্রে নগদ প্রণোদনা দিলে আমরা নিশ্চিত করেই বলতে পারি- এ খাতটি হবে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের পরে সেরা রপ্তানি খাত।’ তবে রপ্তানি বাড়াতে কমপ্লায়ান্স কারখানার ওপর জোর দিচ্ছে আসবাব রপ্তানিকারকদের সংগঠন।
আর সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে রপ্তানি বাড়ানোর পাশাপাশি এ খাতে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে দাবি করছে আসবাব রপ্তানিকারকদের সংগঠন। তবে আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে আসবাব নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো- ইপিবির। আসবাবপত্র- দরকার আর নান্দনিকতা মিলিয়ে বাসা-বাড়ি, অফিস কিংবা হোটেল-রেস্টুরেন্টের সঙ্গে তাল মিলিয়েই যেন বাড়ছে খাট-সোফা, চেয়ার-টেবিল সহ নানা ধরনের আসবাবের চাহিদা।
সিরামিক ও ক্রোকারিজ পণ্য
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বিদেশ থেকে সিরামিক পণ্য আমদানি করে দেশের চাহিদা মেটানো হতো। তখন চীন, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশ থেকেই এসব পণ্য আনা হতো। মূলত ২০০০ সালের দিকে এ খাতে মোটামুটি বিপ্লব ঘটে যায়। উন্নতমানের সিরামিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মুন্নু, শাইনপুকুর, পিপলস, আরএকে, সিবিসি, ফার, স্ট্যান্ডার্ড, বেঙ্গল ফাইন সিরামিকসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ সিরামিক পণ্য প্রস্তুতকারী সমিতি (বিসিডব্লিউএমএ) সূত্র জানিয়েছে, সিরামিক শিল্পে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ৪৭টি প্রতিষ্ঠান তৈজসপত্র, টাইলস ও সেনেটারি পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করছে। এ খাতের স্থানীয় বাজারের পরিমাণ প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।
তবে সমস্যার কথা হলো, সিরামিক শিল্পের কাঁচামাল আমদানি সবই আমাদানি করতে হয়। তবে টাইলসের জন্য মাটি ও সিলিকা বালু যথাক্রমে ময়মনসিংহ ও সিলেট থেকে পাওয়া যায়। ভারত ও চীন থেকে আনতে হয় তৈজসপত্র উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষ মাটি।
বিয়ে, জন্মদিন, বিয়ে বার্ষিকী ও বিভিন্ন দিবসে উপহার হিসেবে তৈজসপত্রের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। সাধ ও সাধ্যের মধ্যে প্রয়োজনীয় জিনিস হিসেবে উপহারের তালিকায় রয়েছে শীর্ষে। বর্তমানে বাজারে সিরামিক পণ্যগুলো বেশ টেকসই ও গুণগত মানে উন্নত। শুধু উপহার নয়, নিজের ঘরের অতি প্রয়োজনীয় অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্রোকারিজ পণ্য। কোয়ালিটি এবং ডিজাইন অনুসারে দামের তারতম্য হয়। এ ছাড়া প্রতি সেটে পিসের সংখ্যা যত বাড়বে তার দামও তত বাড়বে। ব্যবসায় করার একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে ধরা যায়। এই শিল্পের বিস্তার ততোটা হয় নি এখনও। নতুন উদ্যোক্তাগণ আরও বিপ্লব ঘটিয়ে হয়ে যেতে পারেন মার্কেট লিডার। বৈদেশিক চাহিদা মেটাতেও ভুমিকা পালন করছে এই শিল্পটি।
চামড়া শিল্প
তৈরি পোশাকের বাইরে বাংলাদেশি যেসব পণ্য আন্তর্জাতিক মার্কেট এ বেশি রপ্তানি হয়, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চামড়া। গেল ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এ দেশ থেকে ৫০ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের চামড়া রপ্তানি হয়। রপ্তানি বেড়েছিল আগের বছরের চেয়ে প্রায় সাড়ে ২৬ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৩৯ কোটি ৯৭ লাখ ডলারের চামড়া। বাংলাদেশের চামড়ার বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। এর মধ্যে বেশি যায় ইতালিতে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং জাপানেও চামড়ার রপ্তানির পরিমাণ বেশ ভালো।
আলোচিত শিল্পগুলো এখনো ততোটা বিকাশ ঘটাতে পারেনি। আলোর মুখ দেখা শুরু করেছে। দিনান্তে আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে যাবে তার পদচারনা। অন্যদিকে বাংলাদেশি যুবক-যুবতিদের মাঝে নতুন স্পৃহা জাগছে ব্যবসায় করার। চাকরির পিছনে না ছুটে ধরনা দিচ্ছে নিজের যোগ্যতা দিয়ে উপার্জন করার পথে। সফলতা অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে এমন শিল্পগুলো অনেকের কাছেই অজানা। তবে চামড়া, বাইসাইকেল, আসবাবপত্র, সিরামিক পণ্যের চাহিদা রয়েছে সর্বদা। দিন দিন আরও বাড়ছে। নতুন ব্যবসায় করার কথা ভাবছেন যারা, যোগ দিতে পারেন এসব শিল্পে।
পরিসংখ্যান সম্পর্কিত তথ্যগুলো নেয়া হয়েছে, প্রথম আলো, ইত্তেফাক, সময় টেলিভিশন ওয়েবসাইট এবং সামহোয়ার ব্লগ থেকে।